পাখিকে টেম করার উপায় (ভিডিও সহ)
পাখি টেমিং নিয়ে অনেকেরই ধারণা – পাখি কে একা রাখতে হবে, সঙ্গী পাখি রাখলে বা জোড়া দিলে পাখি টেম থাকবেনা বা মালিকের বাধ্য থাকবেনা। এই ধারণাটি যে মারাত্মক ভুল এবং এটি পরবর্তীতে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে – সেটি অনেকের ই জানা নেই। তাই এই বিষয়ে বিস্তারিত বলছি , যাদের টেম পাখি আছে অথবা পাখি টেম করার প্ল্যান আছে, তারা অবশ্যই ভালোভাবে পড়ুন।
পাখি একা রাখার সুবিধা – অসুবিধা :
১. পাখি একা রাখলে পাখির মালিকের সাথে যেই সখ্যতার সৃষ্টি হয়, সেখানে অতিরিক্ত নির্ভরতা চলে আসে মালিকের উপর। মালিক কে দীর্ঘসময় না দেখলে পাখির ভেতর ভয়, নিরাপত্তাহীনতা, নিঃস্বঙ্গতা অতিমাত্রায় কাজ করে যেটা পাখির বয়স বাড়ার সাথে সাথে তীব্র আকার ধারণ করে। এক পর্যায়ে পাখি ও পাখির মালিক উভয়ের ভেতর অপ্রত্যাশিত হতাশা এর সৃষ্টি হয়।
২. পাখি দীর্ঘদিন অন্য পাখির সঙ্গে না পেলে বিভিন্ন বিহেভিওরাল ডিসর্ডার = আচরণগত সমস্যা দেখা যায় যেমন – এন্টি-সোশ্যাল বিহেভিয়ার /অসামাজিক আচরণ, এগ্রেসিভ আচরণ, মুড সুইং, হঠাৎ করে খাবারে অরুচি , অতিরিক্ত চেঁচামেচি ইত্যাদি।
৩. টেম পাখি সঠিক সময়ে জোড়া না দিলে দিয়ে অ্যাডাল্ট হবার পর সহজে জোড়া নেয় না , আবার ব্রিডিং মুড এ আসলে সঙ্গীর অভাবে পার্চ বা অন্য কোনো বস্তুর সাথে মেটিং এর চেষ্টা করে। সঙ্গীর অভাব বোধ চরমে গেলে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে এমনকি মালিক কেও আক্রমণ করে ফেলে এবং মালিকের প্রতিও বিরক্তি চলে আসে।
৪. টেম পাখি মালিকের যত আদরের ই হোক, ইচ্ছাসত্ত্বেও অনেক সময় পাখিকে যথেষ্ট সময় দেয়া সম্ভব হয় না, হঠাৎ ব্যস্ততা অথবা পাখিকে রেখে কিছুদিনের জন্য শহরের বাইরে বা দেশের বাইরে যাওয়া প্রয়োজন হতেই পারে। এই সময়টা অনেক পাখি ই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনা। নিঃসঙ্গতা, অনিশ্চয়তা, দুঃখবোধ থেকে মানসিক ভাবে বিদ্ধস্ত হয়ে পরে। অনেক ক্ষেত্রে খাওয়া দাও বন্ধ করে দেয়। এ থেকে শুধু আচরণ গত ও মানসিক সমস্যাই নয়, শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এধরণের পরিস্থিতিতে পাখির শরীর হঠাৎ বিপর্যস্ত [কলাপ্স] হয়ে যেতে পারে, স্ট্রোক /সিইজার/হার্ট এটাক/প্যারালাইসিস/শারীরিক শিথিলতা ঘটে খুব সহজেই। এ থেকে পাখির মৃত্যু ও ঘটার ঝুঁকি থাকে। এধরণের পাখির চিকিৎসা করাও খুব কঠিন হয়ে পরে কেননা এই ক্ষেত্রে একই সাথে শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয়ের চিকিৎসা দিতে হয় এবং খুব কম সময়ের মধ্যে সেটা সম্ভব না হলে পাখির জীবন বাঁচানো খুব কঠিন হয়ে পরে। পাখি চিকিৎসা অভিজ্ঞতায় এ ধরণের অনেক কেস আমার কাছে আসে।
৫. পাখি একা থাকলে নাইট-ফ্রাইট হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে এবং নাইট-ফ্রাইট এর ধকল কাটিয়ে উঠাও খুব কঠিন হয়। নাইট -ফ্রাইট থেকে সুস্থ পাখি মুহূর্তের মধ্যে ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে পরে , প্যারালাইজড হয়ে যায় এমনকি ব্রেন-স্ট্রোক /হার্ট-এটাক হয়ে পাখি অকাল মৃত্যুবরণ করে।
পাখি সঙ্গী সহ রাখার সুবিধা অসুবিধা –
১. ছোটবেলা থেকে পাখি যখন সঙ্গী পাখি /পাখিদের সাথে বড় হয়, তখন একে অন্যের দেখাদেখি দ্রুত পোষ মানে, একসাথে মিলেমিশে খেতে গিয়ে খাবারের অভ্যাস সুন্দর হয়. একে অন্যের সাথে খেলাধুলা করে প্লে-ফুল আচরণ স্টিমুলেট হয়। পাখির সামাজিক আচরণ সঠিক ভাবে বিকোশিত হয়।
অনেকে যারা এধরণের সমস্যায় পড়েছেন, পাখি শাকসবজি ফল খায় না , তারা সঙ্গী পাখি দেবার পর দ্রুত সমস্যা সমাধান হতে দেখেছেন। অনেকের অসুস্থ পাখি চিকিৎসা করতে গিয়ে যখন দেখেছি যে অসুস্থতার কারণ দীর্ঘদিনের অপুষ্টি থেকে দুর্বলতা , তাদের কে আমি আমার পাখিদের সাথে রেখে দেয়া ছাড়া আর কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন এ হয়নি কারণ তারা আমার পাখিদের দেখাদেখি অতিদ্রুত স্বাস্থসম্মত খাবার খেতে শিখে গেছে যা তার মালিক মাসের পর মাস চেষ্টা করেও পারেন নি
২. পাখিটি অসুস্থ হলে সঙ্গী পাখিটার সার্বক্ষণিক সঙ্গ ও আন্তরিকতা দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করে। পাখির মালিক এমন অবস্থায় যতই সময় দিক বা যতই যত্ন নিক, অসুস্থ পাখিটির সাথে দিন রাত ২৪ ঘন্টা সময় দেয়া বা তার খাঁচায় ঢুকে তার পাশে বসে থাকা অসম্ভব। কিন্তু এই সঙ্গ তার খুব ই প্রয়োজন যা একমাত্র তার সঙ্গী পাখির থেকেই সে পেতে পারে।
এমনটি আমার পাখিদের ক্ষেত্রে এবং অন্যদের পাখিদের ক্ষেত্রে প্রচুর ঘটতে দেখি। অসুস্থতা সামান্য হোক বা বেশি, সঙ্গী পাখিদের আন্তরিকতার জন্য সামান্য চিকিৎসা এমনকি চিকিৎসা ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে পাখি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠে।
অনেক বছর আগে আমার বাজেরিগার এর মা তার একটি বাচ্চাকে আক্রমণ করে মারাত্মকভাবে আহত করেছিল , মাথা ও নাক খুবলে ফেলেছিলো এবং ভয়াবহ ব্লিডিং হয়ে চোখ নাক মুখ ভড়ে গিয়েছিলো। বাচ্চাটি এতো আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল যে তার চিকিৎসা বা খাওয়ানো তো দূরের কথা তাকে স্পর্শ করলেও সে ভয়ে চিৎকার করে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছিলো। এমন অবস্থায় তার চেয়ে ছোট যে বেবি টা ছিল, তাকে আমি হ্যান্ডফিড করার পর সে গিয়ে আহত বাচ্চাটিকে খাইয়ে দিতো,রক্ত জমে বন্ধ হয়ে যাওয়া চোখ, নাক পরিষ্কার করে দিতো। ওর যত্নেই বেঁচে গিয়েছিলো আহত পাখিটি।
আরেকবার আমার টেম ককাটিয়েল জোড়ার ফিমেল টি এগ-বাইন্ডিং থেকে সারা শরীর প্যারালাইজড হয়ে যায়। এই অবস্থায় সে সম্পূর্ণ অচল হয়ে পরে। আমি এবং তার সঙ্গী পালা করে তার সেবা করি ২৪ ঘন্টা একটানা ৭ দিন , এরপর ও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে হয়ে ওঠে।
৩. মিডিয়াম ও লার্জ প্যারোট রা অনেক টেম হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে বয়স বাড়ার সাথে সাথে হঠাৎ কামড় দেয়ার প্রবণতা দেখা যায়, কিন্তু সঙ্গী থাকলে তারা একে অন্যকে আদর করতে, চুলকিয়ে দিতে শিখে এবং কামড়ের প্রবণতা অনেক কমে যায় বা চলে যায়।
আমার আফ্রিকান গ্রে টি খুব ছোটবেলা থেকেই হঠাৎ হঠাৎ অনেক জোরে কামড় দিতো এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রবণতা টি বাড়তে শুরু করেছিল , যদিও ও ফুল টেম & ট্রেইন্ড। আমার কাকাতুয়া আসার পর যখন গ্রে টি কাকাতুয়া কে কামড়াতে চেষ্টা করতো , কাকাতুয়া গ্রে এর ঠোঁট তার নিজের ঠোঁট দিয়ে আটকে দিতো এবং আদর করতো। এভাবে চলতে চলতে গ্রে এর কামড়ানোর অভ্যাস তা চলে গেলো এবং কাকাতুয়া না, আমার প্রতি ও সে অনেক বেশি আন্তরিক হয়ে উঠলো।
৪. সঙ্গী সহ থাকলে পাখির নাইট-ফ্রাইট খুব কম ই হয়, হলেও পাখি এর ধকল দ্রুত কাটিয়ে উঠে।
৫. পাখি একা রাখলে পাখি উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে মালিকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরে এবং ঘনিষ্ট হয় – কিন্তু হঠাৎ দূরত্বের কারণে পাখি এগ্রেসিভ হয়ে যাওয়া এবং টেম নষ্ট হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
কিন্তু সঙ্গীসহ থাকলে পাখি বাধ্য হয়ে না – বরং নিজের আগ্রহে পাখি মালিকের সাথে ঘনিষ্ট হয়, মালিকের সাথে পাখির শর্তহীন খাঁটি ভালোবাসার বন্ধন সৃষ্টি হয়। মালিকের ত্যেকে কিছুদিন দূরে থাকলেও তার ভেতর ইনসিকিওরিটি/ নিরাপত্তাহীনতা বোধের সৃষ্টি হয়না, মালিকের প্রতি বিশ্বাস ভঙ্গ হয় না , নিঃস্বঙ্গতা থেকে মানসিক/শারীরিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি থাকে না।
আমার টেম পাখিদের রেখে প্রায় ই আমাকে দেশের বাইরে দীর্ঘদিনের জন্য যেতে হয় কিন্তু এতে করে আমার পাখিরা কখনোই নিঃস্বঙ্গতায় ভোগেনা, এগ্রেসিভ হয় না এবং আমাকে ভুলেও যায় না.
পরিশেষে – টেম পাখিকে জোড়া দিলে বা সঙ্গী দিলে টেম থাকে না , এটি ১০০% ভুল ধারণা। আমার সবচেয়ে টেম মেল্ ককাটিয়েলকে যখন একটা ব্রিডিং ফিমেল এর সাথে জোড়া দিলাম, ফিমেল টা দ্রুত টেম হয়ে গিয়েছিলো। এরপর থেকে তারা দুজন আমাকে একসাথে আদর করতো, একসাথে খেলতো আমার সাথে। ব্রিডিং থাকা অবস্থাতেও ডিমে তা দেয়ার ফাঁকে নিজে এসে খেলতো আমার সাথে। আমার অন্য টেম পাখিদের সাথেও এমন অনেক সুন্দর মুহূর্ত কেটেছে, একসাথে সবাইকে নিয়ে সময় কাটাতে গিয়ে অনেক সময় তারা আমাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি করতো , খুনসুটি করতো, আমি ছিলাম তাদের সবার সবচেয়ে প্রিয় খেলনা। এই শর্তহীন লাগামছাড়া আনন্দ যে কি অসাধারণ , যারা সিঙ্গেল টেম পাখি পেলেন, তারা ধারণাও করতে পারবেন না। কাউকে বাধ্য করে , অসম্পূর্ণ রেখে তার ভালোবাসা পাওয়ায় কোনো কৃতিত্ব নাই, তাকে সম্পূর্ণতা দেয়ার পর যখন তার ভালোবাসা অর্জন করা যায়, কৃতিত্ব সেখানেই , টেমিং এর সফলতা সেখানে।
— সিফাত ই রব্বানী
ভিডিওতে দেখুনঃ
No Comments