ফেদার প্লাকিং – Feather Plucking
খুব পরিচিত ও বিরক্তিকর একটি অভিজ্ঞতা, এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হননি এমন ব্রিডার খুজে পাওয়া একটু কষ্টকর মনে হয়। খুব সুন্দর সুন্দর বাচ্চা কাচ্চা আসছে হারিতে, বুকে আশা নিয়ে অপেক্ষা… ঠিক তখনই হঠাৎ একদিন এই বেদনাদায়ক দৃশ্য আপনার চোখের সামনে। এটা এমন একটি অসুখ বা সমস্যা, আপনি এটাকে রোগ নাকি মানসিক সমস্যা কোনোটাই বলতে পারবেন না। এই রোগ টিকে মেডিকেল ভাষার বলা হয় ট্রাইকটিলোম্যানিয়া (TRICHOTILLOMANIA) – যার কারনে রোগী নিজের গায়ের পশম, চুল এমনকি চামড়াও কামড়ে তুলতে ফেলে। এই রোগটি মানুষ সহ অন্যান্য প্রানীর মধ্যেও লক্ষ করা যায়।
বাজরিগার পাখির ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় ফেদার প্লাকিং এর প্রভাব বাচ্চা দের উপর দিয়েই যায়। এর পেছনে অনেক ধরনের কারন থাকতে পারে যেমন – পরজীবির আক্রমণ, এলার্জি, একঘেয়েমি ও বিসন্বতা, অতিরিক্ত প্রজনন হরমোন, যক্রিতের রোগ, অপুষ্টি, বাতাসে আদ্রতা, বিশুদ্ধ আলো বাতাসের ঘাটতি, ব্রিডিং এ পছন্দের সংগী না পাওয়া, হারিতে বাচ্চা থাকা অবস্থায় বার বার বিরক্ত করলে, এমনকি কোনো কোনো সময় এটি জেনেটিক্যালি বহন করতে পারে। তবে সবচেয়ে দুখঃজনক বিষয় হলো বাজরিগার এর ক্ষেত্রে ফেদার প্লাকিং এর সঠিক কারন বেশিরভাগ সময়ই আপনি ধরতে পারবেন না। কিন্তু আপনি কিছু বিষয় মেনে চললে পাখির ফেদার প্লাকিং এর হার অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।
👉এখন আসা যাক বাজরিগার এর ক্ষেত্রে কি কি সম্ভাব্য কারনে আপনার পাখি ফেদার প্লাকিং এর সম্মুখীন হতে পারে ও এর থেকে প্রতিকার বা পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে কিছু আলোচনা।
১/ পরজীবি ও এলার্জিঃ আপনার পাখির শরীরে উকুন ও বিভিন্ন পরজীবির আক্রমণ থাকলে তারা চুলকানির প্রভাবে এক সময় বিরক্ত হয়ে গায়ের পশম কামড়ে তুলে ফেলে, একই ঘটনা এলার্জির ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে।
সমাধানঃ পরজীবির আক্রমণ ও এলার্জির থেকে রক্ষা করতে পাখিকে আপনি মাসে ১-২ বার করে নিম পাতা সিদ্ধ পানি দিয়ে গোসল করাতে পারেন ও পুরো এভিয়ারি স্প্রে করতে পারেন, ১-২ বার রসুন পানি দিয়ে একই পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। এছাড়াও মাসে ১ বার (acimec 1% oral solution) ঔষধ টি লিটারে ২ মিলি ব্যাবহার করে পাখিকে গোসল ও এভিয়ারি স্প্রে করতে পারেন।
২/ একঘেয়েমি ও বিসন্বতাঃ এটি পাখির ফেদার প্লাকিং এর জন্য খুবই জোরালো একটি সমস্যা। পাখি যদি বেশিদিন পর্যন্ত সংগী ছাড়া থাকে, আবার একই সংগীর সাথে বেশিদিন একসাথে থাকলে, পাখিকে টানা ব্রিডিং করালে, পাখি রেস্টে থাকা অবস্থায় পর্যাপ্ত বিনোদন না পেলে সেক্ষেত্রে এই সমস্যাটি দেখা যায়।
সমাধানঃ পাখিকে পর্যাপ্ত রেস্ট দিতে হবে, পাখিকে তার সংগী নির্বাচনের সুযোগ দিন, মিউটেশন নিয়ে কাজ করার তাড়নায় তাকে বার বার আপনার পছন্দ মত জোড়া দিবেন না। খাবারে ভিন্নতা থাকতে হবে, একই খাবারে পাখি বোর হয়ে যেতে পারে তাই সিড মিক্সে বিভিন্ন প্রকার মিলেট ও ওটস ব্যাবহার করতে পারেন, বড় ফ্লাইং কেইজ দিন এবং কেইজে পাখির বিনোদন এর জন্য বিভিন্ন খেলনা যেমন – বল, দোলনা, আয়না, মই এসব দিতে পারেন।
৩/ প্রজনন হরমোনঃ বাজরিগার ফেদার প্লাকিং এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী এই কারনটি। পাখির শরীরে প্রয়োজন এর অতিরিক্ত প্রজনন হরমোন বেড়ে গেলে এই সমস্যা বেশি দেখা দিবে, এবং এর জন্য বেশিরভাগ সময় আমরাই দায়ী। পাখিকে জোড় পুর্বক মুডে আনার জন্য ব্রিডিং এর আগে অনেকেই বিভিন্ন সাপ্লিমেন্ট বা প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধির ঔষধ ব্যাবহার করে থাকি যার প্রভাবে পাখির বাচ্চা বড় না হতেই পাখি আবার মুডে চলে আসে এবং পরবর্তী ব্রিডিং এর জন্য পাখি অস্থির হয়ে উঠে এই অবস্থায় তারা বাচ্চা কে তাদের শত্রু মনে করে বাচ্চার উপর আক্রমণ করা শুরু করে।
সমাধানঃ পাখিকে কখনই ব্রিডিং এর জন্য জোড় করা যাবে না, অতিরিক্ত ব্রিডিং সাপ্লিমেন্ট ব্যাবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে সম্ভব হলে একেবারেই ব্যাবহার করা বন্ধ। হারিতে বাচ্চা থাকলে পাখিকে মাঝে মাঝে সেলাইন পানি দিন। বার বার হারি বের করা যাবে না, বাচ্চা নিজে খাওয়া না শিখা পর্যন্ত হারি থেকে নামিয়ে দিবেন না এতে পাখি বিরক্ত হয়ে বাচ্চার উপর হামলা করতে পারে, বাবা পাখিটি যাতে স্ট্রেসে চলে না আসে সেজন্য খাচায় একটি আয়না রাখতে পারেন, মা পাখি বাচ্চা খাওয়াতে যেয়ে যাতে বেশি বিরক্ত না হয় এজন্য বড় হারি দেয়া উত্তম। প্রতিদিন বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য নরম খাবার দিতে হবে।
৪/ অপুষ্টিঃ অপুষ্টিতে ভোগা পাখি সাধারণত খালি চোখে বোঝা যায় না, যতক্ষন না সে দুর্বল হয়ে পরে বা অপুষ্টি জনিত কারনে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়। শরীরে ক্যালসিয়াম জিংক ও মিনারেল এর ঘাটতি থাকলে পাখির পালক উষ্কখুষ্ক হয়ে থাকে ও পালকের গোড়া শুষ্ক হয়ে ফেটে যেতে পারে। তখনই পাখি ক্যালসিয়াম মিনারেল ও জিংক এর ঘাটতি পুরনে নিজের বা বাচ্চাদের ফেদার খাওয়া বা তুলে ফেলার প্রবনতা দেখা যায়। এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পায় ব্রিডিং এর সময়কালে, কারন ব্রিডিং এ পাখির শরীর থেকে সর্বোচ্চ পরিমান শক্তি ও পুষ্টি ব্যাবহার হয়ে যায়।
সমাধানঃ পাখির জন্মের পর থেকে সারা বছর একটি সু-নিদৃষ্ট গোছানো পুষ্টিকর ডায়েট চার্ট মেইনটেইন করতে হবে৷ প্রচুর শাক-সবজি, ফলমূল খাওয়াতে হবে যেসব খাবারে ক্যালসিয়াম, জিংক, এমাইনো এসিড, প্রটিন, মিনারেল ও আয়রন এর সোর্স বেশি সেসব খাবার পাখিকে প্রতিনিয়ত দিতে হবে। সম্ভব হলে সপ্তাহে ৭ দিন কোনো না কোনো শাক-সবজি বা ফলমূল দিন। এবং জন্মের পর থেকে পাখির প্রথম মল্টিং পর্যন্ত সম্ভব হলে ১ দিন পর পর অল্প অল্প করে হলেও এগ ফুড খেতে দিন। কারন এ সময় পাখির দৈহিক বৃদ্ধি ও পালক এর গঠন ৯০% হয়ে যায়।
৫/ অভ্যাস বা মানসিক সমস্যাঃ এই অভ্যাস বা বদ অভ্যাস অথবা মানসিক সমস্যা যেটিই বলেন এটাই হচ্ছে পাখির বাচ্চাদের ফেদার খেয়ে ফেলার বা তুলের ফেলার জন্য সবচেয়ে বড় কারন। এখানে কিছুটা জেনেটিক্যাল ব্যাপার ও কাজ করে। একটা পাখি যখন যেকোনো কারনে একবার ফেদার প্লাক করা শুরু করে তখন পাখি এটাকে অভ্যাসে পরিণত করে নেয়। আর এই অভ্যাস পরিবর্তন করার মত কোনো সমাধান এখনো বের হয়নি। এটি এতটাই বিপদজনক মানসিক সমস্যা যে কারনে একটি সুস্থ পাখি (অর্থাৎ যে কখনো ফেদার প্লাক করেনি) তাকে যদি একটি ফেদার প্লাক করে এমন পাখির সাথে জোড়া দেয়া হয় তাহলে সুস্থ পাখিটিও ফেদার প্লাক করা শুরু করে। এবং কিছু কিছু বাচ্চাদের মধ্যে এর প্রভাব বেপক আকারে পরে, যার কারনে সেই বাচ্চাও বড় হয়ে ব্রিডিং-এ যেয়ে একই সমস্যা দেখায়।
এর থেকে সমাধান এর সঠিক পন্থা আসলে কারোই জানা নাই, বা এখনো বের করা সম্ভব হয়নি। আপাতত কয়েকটি ব্যাবস্থা গ্রহনের মাধ্যমে আপনি এই সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে পারেন। যেমন – বাচ্চা ফস্টার করে দেয়া, বাচ্চার গায়ে ACV বা এলোভেরা লাগিয়ে দিতে পারেন এতে করে তেতো ভাবের কারনে বাচ্চার গায়ে কামড় দিবে না, বাজারে বিভিন্ন প্রকার এন্টি ফেদার প্লাক এর স্প্রে পাওয়া যায় সেগুলো ব্যাবহার করে দেখতে পারেন।
★ কিছু ভুল ধারনাঃ আমাদের মধ্যে কিছু প্রচলিত ভুল ধারনা আছে, যেমন – বাচ্চাকে বাবা মা ফেদার প্লাক করলে সাথে সাথে ক্যালসিয়াম + জিংক এর কোর্স দেয়া, ক্যাটল ফিস বোন মিনারেল ব্লক দেয়া, পাখিকে এগ ফুড বাড়িয়ে দেয়া। আসলে এগুলো সবই আমাদের ভুল ধারনা ও অকার্যকরী সমাধান। এসব করলে পাখির প্রজনন হরমোন গুলো সতেজ হয়ে উঠে এবং হিতে বিপরীত ঘটার সম্ভাবনা ১০০%। এবং অনেকে মনে করেন আয়োডিন এর ঘটতি তে পাখি ফেদার প্লাক করে, তখন বিট লবন পানিতে মিশিয়ে খাওয়ালে ঠিক হবে, আসলে এটিও কোনো কার্যকরী সমাধান নয়। যদি আসলেই আয়োডিন এর ঘটতিতে এমন হয় তাহলে কি ৪/৫ দিন লবনের পানিতে সে সমস্যা সমাধান হবে? অনেকে বলেন আমি পাখিকে ৬ মাস রেস্টে দিয়েছি প্রচুর মিনারেল ও ক্যালসিয়াম কোর্স করিয়েছি তারপরো পাখি কেন ফেদার প্লাক করে? এটাও ভুল ধারনা, ওইযে বললাম এই বদ অভ্যাস টা হয়ে গেলে সেটা মানসিক রোগে পরিনত হয়। অনেক পাখি বাচ্চা দের খুব ভাল খাওয়ায় এবং ফেদার প্লাক ও করে। ওরা নতুন ফেদার জন্মানোর জন্যই বাচ্চাদের ভাল করে খায়িয়ে বড় করে এবং আবার ফেদার প্লাক করে।
★আরো কিছু সমাধানঃ ফেদার প্লাকিং এর স্থায়ী কোনো সমাধান নেই। তবে, উপরের কারন গুলো ছাড়াও আরো কিছু কারন যেমন এভিয়ারিতে বাতাসে আদ্রতার বেলেন্স রাখা, বিশুদ্ধ আলো-বাতাস এর সরবরাহ নিশ্চিত করা আপনার দায়িত্ব। পাখিকে তার সংগী নির্বাচনের সুযোগ দিন, খাচা ও ট্রে সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন, পাখিকে মাঝে মাঝে সকালের রোদে দিন। টেম করার জন্য ফেদার ক্লিপিং করবেন না, এতে করে অনেক সময় পাখি নতুন পালক উঠার সময় যে চুলকানি হয় তাতে নিজের ফেদার নিজে তুলে ফেলার প্রবনতা আসে। আর একবার ফেদার প্লাক এর অভ্যাস হয়ে গেলে সেটা চলতেই থাকে। পাখিকে কখনই টানা ২ বার ব্রিড করাবেন না, প্রতিবার ব্রিডের পর কমপক্ষে ২-৩ মাস রেস্ট দিন।
★ ফেদার প্লাক হওয়া বাচ্চা দের দ্রুত ফেদার তৈরি হতে টানা ১৫-২০ দিন একটি কোর্স করাতে পারেন – ক্যালপ্লেক্স – ৩ মিলি + ওজিংক – ০.৫ মিলি + পেনামিন – ২ মিলি। এবং এর পাশাপাশি প্রতিদিন শাক-সবজি ও এগ ফুড দিন টানা ১ মাস।
আপনাদের সুবিধার জন্য শুধু বলা– এটাই চিরন্তন সত্য নয়। নিচে নমুনা এর ছবিতে যেমন দেখা যাচ্ছে ২৫ দিনের বড় বাচ্চা কে ফেদার প্লাক করেছে এটা সাধারণত বাবা-মা আবার মুডে চলে আসলে হয়। আর অনেক সময় দেখা যাচ্ছে ছোট থেকেই ফেদার প্লাক করেছে এটা সাধারণত অভ্যাস বসত করে থাকে।
★ভাল থাকুন সবাই, সুস্থ থাকুক সবার পাখি★
Nikhil Khan ভাইয়ের পোস্ট থেকে Pet Lovers of Bangladesh গ্রুপ থেকে নেওয়া।
এছাড়াও পড়তে পারেনঃ
“হিট স্ট্রোক” গরমের সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যা ও সমাধান!
বাজরিগার পাখির সিডমিক্স মিশ্রণ পদ্ধতি (দেশী ও বিদেশি উপকরন)
বাজরিগার পাখির সিডমিক্স মিশ্রণ পদ্ধতি (দেশীয় উপকরন)
পশু হাসপাতাল এবং চিকিৎসকের ঠিকানা ও ফোন নাম্বারঃ
No Comments